ফার্স্ট এইড কিট কি ? এবং বাসায় কেন ফার্স্ট এইড কিট রাখা উচিত !
ফার্স্ট এইড :
কোনো অসুস্থ বা দূর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিকে ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে নেওয়ার পূর্বে বা ডাক্তার আসার আগে তাৎক্ষনিক ভাবে যে চিকিৎসা প্রদান করা হয় তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা বলে।
ফার্স্ট এইডের প্রথম পদক্ষেপই হল সমস্যা শনাক্তকরণ এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান ।
প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্দেশ্যঃ
১।রোগীর জীবন রক্ষা করা।
২।রোগীর অবস্থার অবনতি রোধ করা।
৩।রোগীর অবস্থার উন্নতি করা
সুতরাং , প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিস টি প্রয়োজন তা হলো , ফার্স্ট এইড কিট বা প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স!
ফার্স্ট এইড বক্স কী?
ফার্স্ট এইড বক্স হলো একটি বহনযোগ্য বক্স। এতে অনেক কিছুই থাকতে পারে। যেগুলো নিয়ে প্রাথমিকভাবে ছোটখাটো দুর্ঘটনার মোকাবিলা করা যাবে। যাতে একজন মানুষ কোনোভাবে আহত বা হঠাৎ করে অসুস্থ হলে তাকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যায়। কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, এখন কী করতে হবে রোগীর জন্য। আবার কিছু থাকে, যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে অবস্থা সামাল দিয়ে কিছু সময় পাওয়া যায়, যেটা ব্যবহার করে দুর্ঘটনায় পড়া মানুষকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
ফার্স্ট এইড বক্সে যা যা থাকতে হবে:
১।গজ ব্যান্ডেজ :
খুবই দরকারি একটি উপকরণ যা সিলিন্ডার-রোল আকারে পাওয়া যায়।এই উপকরণটি কাটা ছেড়া,রক্তপাত নিবারনের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে।
২।তুলা বা কটন :
রক্ত নিবারণ,স্যালাইন,ইনজেকশন পুশ করা আগে ব্যবহার হয়ে থাকে।
৩। ক্রেপ ব্যান্ডেজ :
হাড় ফেটে গেলে বা কোথাও মচকে গেলে ক্রেপ ব্যান্ডেজ ব্যবহারে ব্যথা কমে আসে।
৪। সার্জিক্যাল ব্যান্ডেজ :
সহজেই কোনো ক্ষতের ওপরে এই ব্যান্ডেজ আটকে রাখা যায়। তবে খুব ভালো ব্যান্ডেজ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয় না।
৫।কাঁচি :
গজ, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি কিংবা প্রয়োজন অনুযায়ী কাপড় কাটার জন্য কাঁচি দরকার।
৬।সার্জিক্যাল গ্লাভস :
ক্ষতস্থান ময়লা হাত দিয়ে পরিষ্কার করার চেয়ে এটা পরে পরিষ্কার করা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
৭।জীবাণুনাশক বা অ্যান্টিসেপটিক:
ফার্স্ট এইড বক্সে স্যাভলন বা ডেটল, হেক্সিসল, ক্যালেনডুলাসহ কিছু অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমও রাখতে হবে যা জীবানু থেকে রক্ষা করবে।
৮।প্রয়োজনীয় ঔষধ :
জ্বরের মেডিসিন, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, ব্যথানাশক ওষুধ, পেট খারাপ, মাথা ঘোরা ও বমির ওষুধ, খাবার স্যালাইন, বার্ন ক্রিম, ব্যথানাশক মলম, অ্যালার্জির ওষুধ ইত্যাদি বক্সে থাকতে হবে যা বিশেষ মুহূর্তে খুবই কাজে লাগে। এছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও বক্সে রাখা যেতে পারে।
৯।থার্মোমিটার :
শরীরের তাপমাত্রার পরিমাপ করার জন্য এর বিকল্প নেই। খুব সহজেই এটি দিয়ে জ্বর মাপা যায়।
১০।বিপি মেশিনঃ
এটি দিয়ে অতি সহজেই হাই প্রেসার ও লো প্রেসার নির্ণয় করা যায়।বর্তমানে বাজারে ডিজিটাল বিপি মেশিনও পাওয়া যায়।
১১।স্টেথোস্কোপঃ
এই উপকরণ ছাড়া নাকি ডাক্তারিই করা যায় না এটি নাকি চিকিৎসকের প্রতিক। এই উপকরন দিয়ে ঠান্ডা,কাশি,হার্ট বুকে পিটে ধরে চেকআপ করা হয়।
১২।পালস অক্সিমিটার :
করোনা মহামারীতে কারও জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট হলে এটি দিয়ে সহজেই রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা ও হৃৎস্পন্দনের মাত্রা জানা যায়।
১৩।গ্লুকোমিটার :
পরিবারের ডায়বেটিস থাকলে বা কারও রক্তের শর্করা কমে বা বেড়ে গিয়ে তিনি অচেতন হয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর একটি উপকরণ।
বাড়ি,গাড়ি,অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফার্স্ট এইড বক্স ও প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্হাপনা রাখা খুবই জরুরি।
এবার জেনে নেয়া যাক কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কেঃ
১।হঠাৎ কেটে গেলেঃ
ছোট ও অগভীর স্থান থেকে রক্তপাত তেমন হয় না। রক্তপাত হলে ক্ষতস্থানটি চাপ দিয়ে ধরে রাখুন। আক্রান্ত স্থানটি এমনভাবে রাখুন, যেন তা হৃৎপিণ্ডের অবস্থান থেকে একটু উঁচুতে থাকে। বেশি নড়াচড়া করলে রক্তপাত বাড়তে পারে। রক্তপাত বন্ধ হলে পরিষ্কার তুলা বা গজের সাহায্যে অ্যান্টিসেপটিক দ্রবণ দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে নিন। এরপর ব্যান্ডেজ করে রাখুন। বেশি রক্তপাত হলে দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে।
২।হঠাৎ পুড়ে গেলেঃ
ত্বকে গরম পানি পড়লে, কোনো কিছুর ছ্যাঁকা বা গরম ভাপ লাগলে আক্রান্ত স্থানটি কলের পানির নিচে রাখুন অন্তত আধা ঘণ্টা। এরপর মলম বেশ পুরু করে লাগিয়ে রাখুন আক্রান্ত স্থানে। অনাক্রান্ত চামড়ায় এ মলম লাগাবেন না। এভাবে সারা দিনে দু-তিনবার মলম লাগিয়ে রাখুন। তবে গোসলের সময় মলমের স্তর ধুয়ে ফেলে সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।বেশী পুড়লে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে।
৩।হঠাৎ আঘাতঃ
হঠাৎ ব্যথা পেলে আক্রান্ত স্থান বরফ বা ঠান্ডা পানির বোতল দিয়ে চেপে ধরতে পারেন। তবে এগুলো সরাসরি প্রয়োগ করবেন না, পরিষ্কার কাপড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে ব্যবহার করুন। এরপর ব্যথানাশক
ওষুধ সেবন করতে হবে।
৪ l শারীরিক অসুস্থতায়ঃ
জ্বর এলে প্রথমেই জ্বর মেপে নিন। তাপমাত্রা কত পেলেন এবং তা কোন সময়ে মেপেছেন, এ তথ্যগুলো লিখে রাখাই সবচেয়ে ভালো; পরবর্তী সময়ে কাজে লাগতে পারে। হালকা গরম পানি দিয়ে শরীর-মাথা মুছে নিন। সম্ভব হলে হালকা গরম পানিতে গোসল করে নিন। এসবের পরও জ্বর না কমলে জ্বরের মেডিসিন সেবন করতে হবে।
৫। বিদ্যুতায়িত হলেঃ
বিদ্যুতায়িত ব্যাক্তিকে মাটিতে শুইয়ে মাথা এক পাশে কাত করে দিন তারপর কম্বল দিয়ে তাকে ঢেকে রাখুন যাতে সে উষ্ণ থাকে যদি সে পিপাসার্ত বোধ করে তবে তার ঠোঁট ভেজা কাপড় দিয়ে ভিজিয়ে দিন এবং যদি সে অজ্ঞান হয়ে যায় তবে তার শ্বাস প্রশ্বাস লক্ষ্য করুন এবং যত দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
৬। প্রচুর রক্তক্ষরন হলেঃ
যদি প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তবে আহত অংশটিতে তুলা দিয়ে ধরুন এবং চারপাশে চাপ দিন যতক্ষণ না পর্যন্ত রক্ত বন্ধ হয় এরপর কিছুক্ষনের জন্য চাপ বন্ধ করুন এবং রুমাল জাতীয় কোন কাপড় পেচিয়ে নিন।ক্ষত অংশের চারপাশে রুমালটি বেধে নিন এবং একটি গজের মাধ্যমে ক্ষতটিকে ব্যান্ডেজ করুন। যত দ্রুত সম্ভব ভাল চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করুন।
৭। বিষাক্ত কিছু খেলেঃ
কেউ বিষাক্ত কিছু খেলে বমি করানোর চেষ্টা করুন আর দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করুন।
৮। দুর্ঘটনাজনিত বা অন্য যেকোনো কারণে আরও গুরুতর শারীরিক ক্ষতিগ্রস্তরা ও সংকটাপন্ন হওয়ার হাত থেকে রোগীকে বাঁচাতে প্রাথমিক চিকিৎসা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক চিকিৎসা তথা ফার্স্ট এইডের মূল লক্ষ্যই হলো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুহার হ্রাস করা।
প্রাথমিক চিকিৎসার যেসব সরঞ্জামের কথা উল্লেখ করা হলো সেগুলো খুব একটা ব্যয়বহুল নয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলোর ব্যবহারবিধি একজন সাধারণ মানুষ সহজেই শিখে নিতে পারেন। পরিবার, অফিস বা কোনো একটি ভ্রমণকারী দলের সদস্য সংখ্যার উপর ভিত্তি করে উপকরণের পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। ফার্স্ট এইড কিট বা প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো এমন জায়গায় রাখা উচিত যেন তা খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। তবে অবশ্যই বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
যে জাতি যত প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে ধারনা রাখবে সেই জাতি স্বাস্থ্য বিষয়ে তত উন্নত হবে।